করোনা, প্রতিরোধের সঙ্গে জরুরি জোরকদমে প্রতি আক্রমণও

করোনা, প্রতিরোধের সঙ্গে জরুরি জোরকদমে প্রতি আক্রমণও
সুমন ঘোষ
একুশ দিন। অতি গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর একুশ দিন মা ও সন্তানকে একটি আলাদা ঘরে থাকতে হত। একুশ দিন পর নিম, তেল, হলুদ দেওয়ার পর বাইরে বের করা হত। পুরনো সেই দিনের কথা আজ হয়তো অনেকের বিস্মৃতির অতলে। এখন তা টিকে রয়েছে কিছু প্রবাদে। বয়সে ছোট কেউ কিছু না পসন্দ বলে ফেললে, বলা হয় একুশে যায়নি, মুখে বড় বড় কথা।
একুশ দিন। অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারও পক্স হলে একুশ দিন আলাদা ঘরে থাকতে হত। এমন কত একুশেই পাওয়া যাবে। একুশে আইন, একুশে ফেব্রুয়ারী। আবার এক কঠিন সময়। এবার করোনা। আবার ঘুরে এলো একুশ। লক ডাইন। একুশ দিন। এই একুশ দিন অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, এই একুশ দিনের গুরুত্ব। এই একুশ দিন বাইরে বেরোনো যাবে না। কিন্তু শুধু তা করলেই কী করোনা মোকাবিলা সম্ভব। এটা রোগ মোকাবিলার একটা বড় অঙ্গ তা নিয়ে সম্দেহ নেই। কিন্তু বাকি কাজগুলি না করলে এই একুশে বৃথাও যেতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদেরই।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, একুশ দিন হোম কোয়ারান্টাইনে থাকার অর্থ করোনা মোকাবিলায় ৫০ শতাংশেরও বেশি এগিয়ে থাকা। কারণ, দলগতভাবে মানুষ একে অপরের সংস্পর্শে না এলে এই রোগ ছড়ানোর ভয় নেই। কমিউনিটি সংক্রমণ তো অনেক পরের ব্যাপার।
প্রশ্ন এখানেই।
হোম কোয়ারান্টাইন কী সবার জন্য উপযুক্ত। এটা কেবলমাত্র একাংশের জন্য সেফ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। তাঁরা আর্থিক দিয়ে স্বচ্ছল। বর্তমানে অনু পরিবার। একটি বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী আর বড়জোর দু’টি সন্তান। চারজনের বসবাস। ফলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে একে অপরের থেকে দুরত্ব বজায় রেখেও সহজেই চলতে পারবেন। কিন্তু যে যুবকটি পেটের তাগিদে ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতে গিয়েছিল তার পরিবারের অনটন নিত্য সঙ্গী। তাঁর বাসস্থানে বড় জোর দু’টি ঘর। অনেক ক্ষেত্রে আবার দরজাও থাকে না। পাশাপাশি, ঘেঁষাঘেঁষি পরিবারের ১২-১৪ জন এক সঙ্গেই থাকেন। আর একটু ওপরে উঠলেও চিত্রটার বেশি বদল ঘটে না। সাধারণ চাষির বাড়িতে চার ভাইয়ের সংসার। সংসার বাড়তে চারটি হাঁড়ি ভাগ হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু সকলে চারটি আলাদা ঘর বানাতে পারেননি। একই ঘরে ভিড়ে ঠাসাঠাসি বসবাস। তাঁদের ক্ষেত্রে হোম কোয়ারান্টাইন কতটা কার্যকরী?
এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পরিসংখ্যান দিলেই এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত এই জেলার বিদেশ থেকে ফেরা মানুষের সংখ্যা ১৭২ জন। অন্য রাজ্য থেকে ফেরা মানুষের সংখ্যা ২০৩১১ জন। সবাইকেই হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। এমনই অন্যান্য জেলাতেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অল্প সংখ্যাক মানুষকে সরকারি ব্যবস্থায় কোয়ারান্টাইনে রাখতে হয়তো বেশি সমস্যা দেখা দেবে না, কিন্তু তা না হলে, তাদের মাধ্যমে যদি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তা কিন্তু রোখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন আরও।
ভারতবর্ষে করোনার বিস্তারের গতি কিন্তু শ্লথ। অর্থাৎ হৈ হৈ করে সবাইকে চেপে ধরছে, এমন নয়। এটাও একটা ভয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, হয়তো করোনা এখানে অনুকুল পরিবেশ পাচ্ছে না। ফলে ধীরে এগোতে চাইছে। এমনটাও তো হতে পারে। যখন দেশবাসী নিশ্চিত হল, অন্যান্য দেশের মতো নির্দিষ্ট সময় পার করে ফেলেছি, আর ভয়ের কিছু নেই। ঠিক সেই সময়েই যদি থাবা বসায় করোনা। এই দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি মানুষ, অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে, তারপর হঠাৎ ঝড়, তখন তো মেরুদণ্ডের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও ভেঙে পড়বে।
তাহলে উপায়?
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, উপায় রয়েছে। যে সময় মানুষ গৃহবন্দি, এই সময়েই তা সেরে ফেলতে হবে। কোয়ারান্টাইন পদ্ধতির ভীতি কাটিয়ে ভরসাযোগ্য করতে হবে। যে সব এলাকার মানুষ ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে ছিলেন, তাঁদের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার স্কুলেই কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা যায়। বাড়ির লোকজনই তাঁদের খাবার পৌঁছে দিয়ে যাবে। সরকারকে খাবারের ব্যবস্থাও করতে হবে না। তবে সঠিক পদ্ধতিতে তাঁরা রয়েছেন কিনা তা আশা কর্মী বা পঞ্চায়েত সদস্য নজরদারি করলেই মিটে যাবে। তারপর সমস্যা দেখা দিলে উপযুক্ত পদক্ষেপ। নতুবা গ্রামেগঞ্জে একবার ছড়িয়ে পড়লে বিপদ।
দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত মানুষ আক্রান্ত বা যাঁদের মধ্যে করোনার উপসর্গ রয়েছে, তাঁদের সংস্পর্শে থাকা তো বটেই, সংশ্লিষ্ট এলাকার সমস্ত মানুষেরই পরীক্ষা জরুরি। আর তা করার জন্য ২১ দিন যথেষ্ট সময় বলেই চিকিৎসকদের অভিমত।
এই কঠিন মুহূর্তে দেশ ও রাজ্যকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দোকান, বাজারেও যাচ্ছেন, যাতে কালোবাজারি না হয়। চিকিৎসকদের মতে, এসবের সঙ্গেই শুধু প্রতিরোধ নয়, করোনা ভাইরাস যদি কারও শরীরে বাসা বেঁধে থাকে, তাও নির্মূল করে ফেলতে হবে। নতুবা এই বিপর্যয় থেকে আমাদের মতো জনবহুল দেশে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। কারণ, সারা দেশে এখনও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এতটা উন্নতহয়নি যে, কমিউনিটি সংক্রমণকে সহজে রোখা সম্ভব হবে। প্রশাসন সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, সেই কাজটি করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ব্যবস্থাও গ্রহন করা হচ্ছে। তা হাসপাতালের কোনও ওয়ার্ডে হোক বা কোথাও চালু না হওয়া হাসপাতালে। এই কাজটি শুধু কোনও একটি রাজ্যে নয়, সারা দেশ জুড়ে না করা গেলে বিপদ।


