পাহাড়ে তো ঘুরতে যাচ্ছেন, ‘মাউন্টেন সিকনেস’ সম্বন্ধে জানা আছে তো? নাহলে ছোট্ট কারণ মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে!

পাহাড়ে তো ঘুরতে যাচ্ছেন, ‘মাউন্টেন সিকনেস’ সম্বন্ধে জানা আছে তো? নাহলে ছোট্ট কারণ মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে!
31 Oct 2023, 02:45 PM

পাহাড়ে তো ঘুরতে যাচ্ছেন, ‘মাউন্টেন সিকনেস’ সম্বন্ধে জানা আছে তো? নাহলে ছোট্ট কারণ মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে!

 

ড. শুভেন্দু বাগ

 

গেল মাসে পড়শীরা অরুনাচল প্রদেশ বেড়াতে গিয়েছিলেন। বোমডিলা থেকে তাওয়াং যাবার পথে গাড়িতে আরও ওপরে ওঠার সময় হঠাৎ যেন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। হালকা মাথা ধরা। পেটটাও যেন মাঝে মধ্যে গুলিয়ে উঠছে। জোরদার প্রাতঃরাশের দিকে তর্জনি তুলে একখান গ্যাসের ওষুধ চালান করলেন পেটে। প্যারাসিটামলও খাওয়া হলো। কিন্তু নৈসর্গিক সৌন্দর্য ছাপিয়েও মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। কন্যার ঠেলাতেও চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। গাড়ি এগিয়ে চলেছে আরও ওপরে। উচ্চতা আঠহাজার ফুট। ধীরে ধীরে পা দুখান অসাড় হতে শুরু করলো। হাতের আঙুল অবশ। ঘোরাচ্ছন্ন অনুভূতি। কন্যার দ্বিতীয় ঠেলায় গাড়ির সিটেই এলিয়ে পড়ল এতদিনের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চেহারা।

তারপর কখন যে নীচে নেমেছে গাড়ি, কখন যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কতক্ষণ অক্সিজেনের হাপরশ্বাসে ছিলেন, সব ভুলে যখন জ্ঞান ফিরলো, সামনে থাকা চিকিৎসকেদের কথাবার্তায় টের পেলেন জল জমেছে ফুসফুসে। অন্য গাড়িতে থাকা আর এক সহ-যাত্রীর মস্তিষ্কে জল জমে গত হয়েছেন তিনি।

বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইলেন শুধু। মুখে রা কাড়বার শক্তি তখনও কুলোয়নি। দিন তিনেক পর কলকাতায় ফিরে যখন গল্প করলেন, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো আমার। পাহাড়ে যাবেন জানতাম। তা সত্ত্বেও “অ্যাসিটাজোলামাইড” এর ব্যবহার সম্বন্ধে না অবগত করানোর অপরাধ বোধ।

উচ্চপার্বত্য অঞ্চলে বায়ুর চাপ কম। তাই অক্সিজেনের অংশচাপ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলতঃ শরীরের প্রতি কোষে অক্সিজেনের পরিমান কমে যত বিপত্তির সৃষ্টি। উচ্চপার্বত্য অঞ্চলে তাই মাথা ধরা থেকে শুরু করে, ঘুমঘুম ভাব, বমি ভাবও যেমন হয় তেমনই মারাত্মক ক্ষেত্রে অবশ হাত, পা (অ্যাটাক্সিয়া), ফুসফুস ও মস্তিষ্কে জল জমে মৃত্যু অবধি ঘটতে পারে।

দুদিন আগে থেকে অ্যাসিটাজোলামাইডের প্রয়োগ অক্সিজেনের ঘাটতিতে শরীরচালনায় অভ্যস্ত করতে সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উঁচু পাহাড়ে ওঠার অন্তত ১ থেকে ২ দিন আগে থেকে এই ওষুধ চালু করা উচিত। পাহাড়ে ওঠার পর আরও দু দিন এই ওষুধ খাওয়া ভালো। সাইড এফেক্ট মামুলি।

যদিও তৎক্ষনাৎ প্রান বাঁচাতে তড়িঘড়ি নিচে নামিয়ে আনা এবং সাথে সাথে অক্সিজেনের প্রয়োগের বিকল্প কিছু নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে পাহাড়ি বাসিন্দারা তাহলে বাঁচেন কি ভাবে?

শেরপারা কিভাবে অনায়াসে মালপত্র সমেত পর্বতারোহীদের সাথে আরোহন করেন? আসলে অভিযোজনের সূত্রে পাহাড়িয়া বাসিন্দারা অল্প অক্সিজেনেই শারীরবৃত্তীয় কাজ চালাতে সক্ষম।

আমাদের শরীরেও পাহাড়ে ওঠার এক থেকে দু দিনের মধ্যেই অভিযোজনের হাত ধরে কিছু পরিবর্তন ওই উচ্চতায় বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতির পোষাকি নাম – অ্যাক্লিমাটাইজেশন।

ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠলে অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য সময় পাওয়া যায় বেশি। তাই সমস্যাও হয় কম। আকাশপথে পাহাড়ে এলে এই অ্যাক্লিমাটাইজেশনের সুযোগ থাকে না। পাহাড়ে আসার পর হঠাৎই যে ঘুম পায়, তাতে না ঘুমিয়ে হালকা পদচালনা করে ফুসফুস সচল রাখা উচিত। প্রথমদিন ঘাম ঝরানো খাটুনি অক্সিজেনের ঘাটতি বাড়িয়ে জীবনশংসয় করে তুলতে পারে।

বাঙালীর পায়ে সরষে। ভ্রমনপ্রিয় এ জাতির পা সাগরে থাকলেও চোখ সবসময় পর্বতমুখী। তাই ট্রাভেল এজেন্সি গুলির অ্যাক্লিমাটাইজেশন ও অ্যাসিটাজোলামাইডের ব্যবহার সম্বন্ধে বিশদ জেনে ভ্রমণকারিকে অবগত করা উচিত। গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা কিছু খরচা বাড়ালেও বিপদকালে প্রাণ বাঁচিয়ে দেবে।

লেখক: প্রখ্যাত চিকিৎসক

Mailing List