এও এক জীবন.../ ধারাবাহিক (সমাপ্ত)

এও এক জীবন.../ ধারাবাহিক (সমাপ্ত)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
আমরা যারা একটু-আধটু লেখালেখিতে যুক্ত থাকি, আমাদের পায়ে কিন্তু বেড়ি। স্বাধীন নই মোটে ব্যক্তিগত জীবনে। আহার-নিদ্রা-মৈথুনের মতো জৈবিক চাহিদার প্রয়োজনে রোজগারের প্রচেষ্টাতেও থাকতে হয়।
সকালে সামান্য একটা ঘটনা মনে এমনভাবে প্রভাব ফেলে দিয়েছিল যে, সারাটা দিন মন দিয়ে কাজ করতে পারলুম না। বলা যেতে পারে জীবিকার সাথে দ্বিচারিতা করে গেলাম আজ। অথচ, ওই জীবিকাটুকু না করতে পারলে এই বুলি কপচিয়ে বা জ্ঞান-গরিমার কথা লিখে গেলে খেতে পাবো না।
অথচ, উপেক্ষাই বা করি কি করে--- সমাজের শিকার হয়ে ওঠা সমাজের তথাকথিত একশ্রেণীর ভদ্দরলোকের কাছে চিরটাকাল ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকা এঁদের কথা! এঁরাই তো সমাজের গরলটিকে অঙ্গে ধারণ করে সর্বংসহা হচ্ছেন।
হ্যাঁ, আপনারা অনেকেই হয়তো বলবেন---"কেন, তারা তো ওর বিনিময়ে পয়সা নিয়ে থাকে... তবে আর উদারতা বা দয়ার ব্যাপারটা থাকছে কোথায়?"
উত্তরে, সবিনয়ে বলতে চাইব, "অবশ্যই তাঁরা অর্থের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করেন; শরীরের সাথে সাথে বিক্রি করেন মন-ও। বিনিময়-প্রথা তো সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই চালু হয়েছে--- তাইতো পুরুষদের অধিকাংশ মনে করেন 'বীরভোগ্যা বসুন্ধরা'; আর যদি গণিকাবৃত্তি করেও তাঁরা অর্থ গ্রহণ না করেন, তবে ওঁদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হবে কিভাবে? সমাজ কি ওঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে? বন্ধু, সমাজ "বেশ্যা" নামের তকমা লাগিয়ে দিতে পারে, ব্রাহ্মণ-সমাজের মানুষেরা ওঁদের ছায়া দিনের বেলায় মাড়ালে পাপ হয় বলে স্নান করতেন--- অথচ রাতের অন্ধকারে হয়তো তারাই হাতে বেলফুলের মালা জরিয়ে, কানের লতিতে আতর মেখে ফুরফুরে মেজাজে সেখানেই আসতেন।"
এখন বাসে ফিরে আসছি সেই শোভাবাজারেই; ওখান থেকে মেট্রোতে বাড়ি ফেরার পালা, ক্লান্ত কলেবরে। আলো লাগানো হচ্ছে দেখলাম...।
জননী আসছেন... হৈমবতী-- শৈলজা-- উমার আগমন ঘটছে এবার। তিনিই আদি জননী, করুণাময়ী মাতৃমূর্তিতে ইন্দ্রাদি দেবতাদের অহঙ্কার পাশ করে ব্রহ্মজ্ঞাণ - তত্ত্ব শিখিয়েছিলেন।
কালের বিবর্তনে, দেবী দূর্গা শরতকালের এই অকালবোধনে মহামায়া বিস্তার করে নয়টি কন্যার রূপে বিরাজিতা হন। কে নন সেই মহা রূপে নবকন্যা? নর্তকী বা অভিনেত্রী, কাপালিক, ধোপানি, নাপতানি, ব্রাহ্মণী, শূদ্রাণী, গোয়ালিনী, মালিনী এবং গণিকা।
নবম রূপে দেবী দূর্গা নিজেকে প্রকাশ করেন।
বিপনন সংস্থার হোর্ডিংয়ে দেবী দূর্গার ছবি জ্বলজ্বল করেছে... তার মধ্যে সমাজের নয়টি উপেক্ষিতা নারীর বিমূর্ত রূপ মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। উজ্জ্বল আলোতে ওই নবমূর্তিতে মা যেন উদ্ভাসিত! মা যেন সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন "এই তো, সবেতেই আমি বিরাজমানা ; সৎ-এও আমি, আবার অসতেও আমি। আমিই যে সব। "
বাস থেকে নেমে সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে মেট্রোর সাবওয়েতে নাবতে নাবতে মনে পড়ে গেল, এই তো কাছেই--- স্টার থিয়েটারে বাঙলার রঙ্গমঞ্চের নিমাইবেশী নটী বিনোদিনীকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব; আবার মথুরবাবু যৌবণের গদাইঠাকুরকে পরীক্ষা করানোর জন্য যখন উত্তর কলকাতার গণিকা-পল্লীর সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ওঁরাও যেমন ঠাকুরের সৌম্য মূর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, তেমনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব-ও ওঁদের উদ্দেশ্যে দুহাত জোড় করে প্রণাম করছিলেন।
" তিনিই সব হয়েছেন..."
ঠাকুরের কথাটা কানে বাজল ...
আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠাকুরের দিব্য সেই ভাবঘন মূর্তি.... তিনি যেন বলছেন:---"তোমাদের চৈতন্য হোক..."
(সমাপ্ত)


