যে কোনও সংঘবদ্ধ অপরাধ হল একটি বিরাট অর্থকরী ব্যবসা, নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ১২, লিখছেন সুখেন্দু হীরা

যে কোনও সংঘবদ্ধ অপরাধ হল একটি বিরাট অর্থকরী ব্যবসা, নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ১২, লিখছেন সুখেন্দু হীরা
সুখেন্দু হীরা
আগেই বলা হয়েছে নারী পাচার একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ (Organised Crime)। আর যে কোনও সংঘবদ্ধ অপরাধ হল একটি বিরাট অর্থকরী ব্যবসা। এই সংঘবদ্ধ অপরাধ বা ব্যবসার নানা ধরনের লোকের নানা ভূমিকা থাকে। একটা সুন্দর 'চেন' (Chain) -এর মাধ্যমে কাজটি হয়। এদের মধ্যে কেউ থাকেন পর্দার আড়ালে, কেউ থাকেন ছদ্মবেশে, কেউ মুখোশ এটে। তাই সবাইকে শনাক্ত করে, একসঙ্গে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করা দুস্কর হয়ে ওঠে। ফলে এই নারীপাচার পৃথিবী থেকে দূর করা কষ্টসাধ্যই বটে।
প্রথমে থাকে একজন মূল পান্ডা। তিনি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থাৎ তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেন, প্রশাসন সামলান। দালালদের সঙ্গে সংযোগ রাখেন। পণ্য বিপণন ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পাচার হওয়া নারীদের গন্তব্য ঠিক করেন।
এর পরের ভূমিকা দালালদের। দালালরা নিজেরা অনেক সময় পাচারের জন্য নারী সংগ্রহ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংগ্রহকারীদের নিয়োগ করেন। সংগ্রহকারীরা শহরে, গ্রামে ঘুরে ঘুরে মেয়ে সংগ্রহ করে চাকরির টোপ দিয়ে, বিয়ে দেওয়ার নাম করে এবং যেসব ছেলেরা প্রধানত নাবালিকাদের ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় প্রেমের অভিনয় করে - সেই সব ছেলেদের নিয়োগ করে।
সংগ্রহকারীরা তৃনমূল স্তরে কাজ করেন। দালালরাও সংগ্রহকারীরা হতে পারেন। সংগ্রহকারীরা ভবিষ্যতে অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে দালাল হন। অনেক সময় সংগ্রহকারীরা সেই প্রেমিক যুবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দেখা গেছে একজন সুদর্শন সংগ্রহকারী একাধিক স্থানে বিভিন্ন নামে একাধিক মেয়েকে, একই সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে ফুঁসলিয়ে পাচার করেছে।
এই পাচার ব্যবসায় অনেক সহযোগী দেখা যায়, তারা বিভিন্ন পেশা বা বিভিন্ন ক্ষেত্রের হতে পারে। যেমন স্থানীয় নেতা, স্থানীয় মস্তান, স্থানীয় ব্যবসায়ী, পরিবহন শিল্পে কর্মরত ব্যক্তি, পাচারকার্যের পথে নানা স্থানের ব্যক্তিরা যেমন ঘাটমালিক, হোটেল-ধাবার মালিক প্রভৃতি। এনারা জেনে বুঝে বা অজান্তে এই পাচার কার্যে সাহায্য করে থাকেন। যেমন পাচার করার সময় যানবাহন ব্যবহার করতে হয়। তা সে ভ্যান রিক্সাই হোক বা ট্রেন-প্লেন হোক। এইসব চালক বা চালকের সহায়ক ব্যক্তিরা অনেক সময় বুঝতে পারেন। কিন্তু ঝঞ্ঝাট এড়ানোর জন্য চুপ থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে এদের জন্য আর্থিক পারিতোষিকও থাকে।
পাচারকার্যে পরিচিতদের কথা আগেই আলোচনা হয়েছে। দেখা গেছে পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ পরিজন তেমন জামাইবাবু, মামা, এমনকি পিতা অবলীলায় শালী, ভাগ্নী ও কন্যাকে পাচারকারীর হাতে তুলে দিয়েছে। এর পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে সেটাও আগে আলোচিত হয়েছে।
পাচার হওয়া মেয়েদের গ্রহীতা সংস্থার ভূমিকা এই পাচারকার্যে সর্বাধিক। এই গ্রহীতা হোটেল মালিক হতে পারে, যৌনপল্লীর কোন ও বাড়ির মালিক হতে পারে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে গ্রামের কোনও বিবাহে ইচ্ছুক পুরুষ হতে পারেন।
যৌনপল্লীতে যেসব পুরুষরা থাকেন তারা অধিকাংশই যৌনকর্মীদের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। অনেক পুরুষ দালালি করে অর্থাৎ খদ্দের ধরে নিয়ে এসে কমিশন পায়। অনেকে শুধু বসে বসে যৌনকর্মীদের উপার্জনে খায়। শুধু তাই নয় যৌনপল্লীর ওপর অনেকের রুজি-রুটি নির্ভরশীল। যৌনকর্মী ঘরে কেউ নেশার জিনিস সরবরাহ করে, কেউ খাবার বিক্রি করে, কেউ রিক্সা করে খদ্দের নিয়ে আসে। স্থানীয় প্রশাসনের ওপর অভিযোগ আছে। এরাও নিয়মিত এখান থেকে তোলা তোলে। এত লোকের স্বার্থ বা আর্থিক উপার্জনের পথ নির্ভর করে আছে যৌনপল্লী তথা যৌনকর্মীদের ওপর। তাই যৌনপল্লীতে জনকর্মীদের আসার পথটা সর্বদা প্রশস্ত রাখতে হয় এইসব ব্যক্তিদের। সমাজের এই চক্র নারীপাচারকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট।
তথ্য ঋণ:
১. অন্য কলকাতা - বিশ্বনাথ জোয়ারদার (আনন্দ আনন্দ পাবলিশার্স)
২. গনিকা দর্শন - অনির্বান বন্দ্যোপাধ্যায় (লিইবার ফিয়েরা)
৩. বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।


