অন্তরিন / বড় গল্প

অন্তরিন / বড় গল্প
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
(এক)
সেকেলে মান্ধাতার আমলের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো।
কালো, জাঁদরেল সেই বৃটিশ-জমানার ফোন। সুন্দরমোহনের খুব পছন্দ এই সাবেকিআনায়।
শুধু ঐ ফোন-ই নয়, আছে আগেকার গ্রামোফোন, রেকর্ডের স্তূপ, বেবি অস্টিন গাড়ি, একগাদা পুরনো দিনের লেখকের গাদাগাদা বইয়ের সারিসারি আলমারি--- আরো কত কি।
পাশেই একটা টেবিলে ইলেকট্রিক পট-এ চায়ের জল চাপানো ছিল; গরম ও হয়ে গেছে--- কাপটা নিয়ে ঢালার অপেক্ষা, এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো।
মনে মনে গজগজ করতে করতে এগিয়ে গেলেন সুন্দরমোহন, ওঃ--- বিকালের এই সময়টায় এক কাপ ব্ল্যাক কফি না পান করলে মাথাটা এমন ধরে যায়--- রাত্রিবেলায় না ঘুমোন অবধি ছাড়ে না।
অবশ্য, এই কফির পেয়ালাটা ঐ ছোকড়া ছেলেটাই দেয়, তা সে আজ ক'দিন হলো দেশের বাড়ি চলে গেছে।
আর এও এক হয়েছে করোণা, নাকি এক মরণ ব্যাধি, যার ফলে গাড়ি-ঘোঁড়া থেকে শুরু করে আপিস-কাপাস সব বন্ধ করতে হয়!
পায়ে পায়ে কফির কাপটা নিয়ে, একটা সুগার কিউব ফেলে চামচে করে নাড়তে নাড়তে ফোনের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল সে।
রিসিভারটা তুলতে যাবে কি রিংটোনটা থেমে গেল।
খুব খারাপ লাগল তার।
নবনীতা হয়তো ফোন করছিল, আমেরিকা থেকে-- হয়তো চলে আসার কথা জানানোর জন্যই ফোনটা করেছিল---।
আবার ফোনটা বেজে উঠলো: এবার আর দেরি না করে রিসিভারটা তুলে নিল সে।
--- হ্যালো, কে বলছেন, ---
ওপারের ব্যক্তিটি নিশ্চুপ।
--- হ্যালো--- কি হল, কে বলছেন--- কাকে চাই, ---
ওপারের ব্যক্তি এবার মুখ খুললেন:
--- আপনি কি মিস্টার সুন্দরমোহন রায়চৌধুরী বলছেন?
--- আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই কথা বলছি, --- আপনি?
--- সুন্দর, আমি জবা বলছি--- চিনতে পারছ আমায়?
--- না, মানে ঠিক--- কোন জবা... একটু যদি বলেন
--- অনেক দিনের পর তো, মনে আনতে কষ্ট হচ্ছে, বুঝি। যাকগে, আর হেঁয়ালি না করে বলি --- ঢাকুরিয়া স্টেশনের গায়েই হলুদ রঙের দোতলা বাড়ির জবা বলছি--- এবার মনে পড়েছে?
--- জবা, ঢাকুরিয়া স্টেশন --- ইন্দ্রাণী--- ?
--- যাক, নামটা তাহলে ভোলোনি দেখছি, তারপর, কেমন আছ , বল সুন্দর--- শুনি।
--- এতদিন পর, তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে জবা?
--- তোমার গলার স্বরে কিন্তু এখনো রোম্যান্টিক--- সেই একই আছে --- কত হলো?
--- এই ফেব্রুয়ারিতে চুরাশিতে পড়লাম।
--- সাতাশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬ --- কি ঠিক বললাম তো, মিস্টার রায়চৌধুরী?
--- এখনও আমার জন্মদিনের তারিখটি তোমার মনে আছে? তবে তোমার গলার স্বরে কিন্তু অনেক পরিবর্তন ।
--- সবারই কি অল ইন্ডিয়া রেডিওর দেবদূলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত কন্ঠস্বরের মিল নিয়ে জন্মাতে পারে সাহেব--- ?
নারীকণ্ঠে ফুটে ওঠে হালকা চাপল্য। হারিয়ে যাচ্ছে ওরা ফেলে আসা নস্টালজিক দিনগুলোতে। কফি ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল---
(ক্রমশঃ)


