হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / দ্বিতীয় কিস্তি  

হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / দ্বিতীয় কিস্তি   
04 Jul 2023, 09:45 AM

হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / দ্বিতীয় কিস্তি

 

ড. প্রভাতকুমার শীট

 

হাতিরা যখন থেকে স্থায়ীভাবে পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করেছে ঠিক তবে থেকে মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত চরম হয়ে উঠেছে। হাতি ও মানুষের মধ্যে ক্ষমতা ও অঞ্চল দখলের লড়াই শুরু হয়। হাতি তাড়ানোর নাম করে হুলাপাটিরা নৃশংস ভাবে হাতিদের পুরুষাঙ্গে ও গায়ে উত্তপ্ত লৌহশলাকার ছেঁকা দেয়। এর ফলে হাতিরা আরো ক্ষিপ্ত ও উগ্র হয়ে ওঠে। এর ফলে প্রাণহানি, ঘরবাড়ি নষ্ট, শস্যখামার নষ্টের মত উপদ্রব লেগেই আছে। হাতি তাড়ানোর জন্য কিছু কিছু জায়গায় শাল জঙ্গলও কেটে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার জন্য কি শুধু হাতি বা মানুষ দায়ী? তা বিচার্য বিষয়!

কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘাঁটলে অন্যরকম ছবি ধরা পড়ে। মহাভারতের যুদ্ধে মদ্ররাজ শল্যের মতো মহারথীদের হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতে দেখা যায়, যার নিদর্শন রয়েছে বহু মন্দিরের ভাস্কর্যে। এ দেশে মৌর্য ও গুপ্তযুগের যুদ্ধেও হাতির ব্যবহার হয়েছে। বাংলার শশাঙ্কের রাজত্বকালে যুদ্ধ ব্যতিরেকে ও তাদের ব্যবহার করা হতো মানুষের প্রয়োজনের বিভিন্ন কাজে। রামায়ণে বাল্মীকির যুগে নৃপতিরা হাতি রাখতেন সযত্নে। তাঁরা 'নাগবান' নামে অভয়ারণ্য বানাতেন হাতিপালন ও তাদের সংকর প্রজাতি সৃষ্টি করতে। 'নাগ' শব্দটির অর্থ হলো হস্তী। ভরত যখন চিত্রকূট পর্বতে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করছেন, তখন রামচন্দ্র নির্দেশ দেন তাঁর নাগবনগুলি যেন যত্নসহকারে রক্ষা করা হয়। কি সুন্দর ভালোবাসা ও মধুর সম্পর্ক ছিল। অযোধ্যা নগরীতে উরাবত, মহাপদ্ম, অঞ্জন এবং বামন প্রজাতির হাতির বর্ননা আছে রামায়ণে। সে সময়কার অতীব সুন্দর দেখতে, শান্ত স্বভাবের দাঁতাল হাতিকে আখ্যায়িত করা হত "প্রিয়দর্শন" নামে। বাস্তবে আজকের যুগে বিশ্বের বৃহত্তম আরণ্যক প্রাণী হলো হাতি। প্রাজ্ঞ অরণ্যবিদগণ হাতিকে জঙ্গলের রাজা আখ্যা দিয়েছেন। যে জঙ্গলে হাতি থাকে সে জঙ্গলে কেউ চুরি করতে ঢোকে না। কাজেই হাতিরা স্থায়ী ভাবে জঙ্গলে বাস করলে জঙ্গলটিও স্থায়ী হয়।

১৯৬০ এর দশকে বাংলা বিহারের মাহুতরা বর্ষচক্রের চুক্তিতে এক রাসপূর্ণিমা থেকে আর এক রাসপূর্ণিমা পর্যন্ত হাতি ভাড়া নিত। এরা ভাড়া হাতির পিঠে চড়ে তার শুঁড়ে তেল-হলুদ লেপে পৌঁছে যেত গ্রাম থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে ছোট বড় শহরে। হাতি দেখিয়ে কিছু রুজি রোজগারের আশায়। হাতি যায় গৃহস্থের আঙিনায়। শুঁড় উঁচিয়ে গৃহস্থের মঙ্গল কামনা করে। গৃহস্থ সরল মানুষ। ইন্দ্রবাহন ঐরাবতের সেবায় সাধ্যমত দান করতেন। সেই দান গ্রহণ করতেন মাহুতেরা। সেইসব দিনগুলি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

আজ থেকে প্রায় ৫০-৬০ বছর আগেও বেলেবেড়া, ঝাড়গ্রাম, রাইপুর, কুইল্যাপাল, রানিবাঁধের রাজারাও হাতি পুষত। এদের হাতি পোষার কারন ছিলো জঙ্গলজাত অর্থনীতি ও রাজ সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে বেলেবেড়া রাজবাড়িতে 'প্রহরাজ' নামের হাতিটি কিংবদন্তি হয়েছিলো। যা বেলেবেড়া রাজ এস্টেটের পরিবার প্রহরাজ পদবির অধিকারী। এ সময় সব এলাকায় পাকা রাস্তা ছিলো না। ছিলো না মোটর চালিত পরিবহন। ফলে জঙ্গলের কাঠ রপ্তানির কাজে হাতিদের ব্যবহার ছিলো ব্যাপক। চিল্কিগড় থেকে ধলভূমগড় পর্যন্ত চালু ছিলো হাতির ডাকব্যবস্থা। পরবর্তীকালে জমিদার প্রথা উচ্ছেদের কারনে ও হাতি পোষার খরচ চালাতে অপারগ হয়ে রাজারা পোষা হাতিগুলি জঙ্গলে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

এখনো ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার সাঁওতাল, হো, কোরা, কুর্মি প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায় শালগাছ ও হাতিকে পূজা করেন। আজও দেখা যায় -আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঘরের দেওয়ালে অলংকরনে ও বড়াম (গড়াম) থানে ডোকরা ও পোড়ামাটির হাতি মানত করার রেওয়াজ। সুতরাং, হাতি হল মনুষ্যজাতির মাঙ্গলিক। তাহলে কেন হাতি ও মানুষের এতই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত?

আজও পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলঘেরা জেলগুলিতে হাতি সমস্যাটি জ্বলন্ত, খবরের কাগজ বা সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে প্রতিনিয়ত। বনদপ্তরের তথ্যে অনুসারে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত হাতির কারনে মানুষের মৃত্যু হয়েছে ১১৪ জনের এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৫৯.৯৯ লক্ষ টাকা। আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের কারনে ১২-১৫ টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৪ এর পর থেকে হাতির কারনে ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০১৫ সালের তথ্যে অনুসারে - সারা রাজ্যে ১০৮ জন মানুষ মারা যায় হাতির কারনে। তার মধ্যে দক্ষিণবঙ্গে ৭১ জন। ২০১৬ সালে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ও হাতি মারা যায় ৪ টি। ওই বছর বাঁকুড়াতে ১৫৭৮ হেক্টর শস্যজমি নষ্ট এবং ১৬৭৭ বসতি বাড়ি ভেঙে দেয়। এরই সাথে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৫০০ হেক্টর শস্যজমি নষ্ট করে বুনোহাতির দল। সরকারকে ১.২১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ২০১৯-২০২০ সালের মধ্যে ১১৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৮০ জন আহত হয়েছে হাতির হানায়। শুধুমাত্র জঙ্গলমহলের জেলাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ৩৫০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাম্প্রতিক (২০২২) হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে ঝাড়গ্রামে জেলাতে চারজন। 

রেসিডেন্সিয়াল হাতিগুলি জঙ্গলে ফেরার ফাঁকে খাবারের খোঁজে লোকালয়ে ঢুকে ফসলের ক্ষতিও করে। হাতির হানায় মানুষের মৃত্যু ও ঘরবাড়ি নষ্ট করে। পাকাধান নষ্ট, বীজতলা নষ্ট, তিল, আলু, নানারকম সবজি নষ্ট করে দেয়। আবার উল্টো দিকে হাতিগুলি কখনো হুলাপাটির তাড়া খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু ঘটে। ২০১৯ সালে মেদিনীপুরের নেপুরাগ্রামে তিনটি দাঁতাল হাতির মৃত্যু হয়েছিল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। হাতির মৃত্যুতে গ্রামবাসীরা শোকে আচ্ছন্ন হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শ্রাদ্ধ শান্তি করিয়ে পাত পেড়ে ভোজও হয়েছিল। তাহলে হাতি ও মানুষের মধ্যে সরাসরি কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নেই। 

চলবে..

লেখক- অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর।

Mailing List