হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / শেষ কিস্তি 

হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / শেষ কিস্তি 
06 Jul 2023, 03:40 PM

হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / শেষ কিস্তি 

 

ড. প্রভাতকুমার শীট

 

গত দশ বছরে ১৬ বার হাতির ঢুকেছে অরণ্য শহর ঝাড়গ্রামে। চলতি বছরেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রশ্ন উঠছে হাতিরা কেন শহরের ঢুকছে? কেনই বা রাজপথে ঘোরাফেরা করছে? তাহলে কি তাদের জঙ্গলে অধিকার ফিরে পেতে চাইছে? এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে ঘুরে বেড়াছে। হাতির বিপদ আমরাই ডাকছি। অনেক সময় সরকারি জমি ও বনভূমি বেশিরভাগই দখল করে বসবাস করছি বা চাষের জমি তৈরি করে ফেলছি। কখনো কখনো জলাভূমি খননের কাজে বনভূমি উচ্ছেদ করছি। তাতেই মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান। জঙ্গল লাগোয়া জনপদে রাত হলেই হাতির উপদ্রব শুরু হয়। ফসল বাঁচাতে রাত জেগে পাহারা দেয় গ্রামবাসীরা। তাড়া খেয়ে হাতিরা দিকভ্রষ্ট হয় ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই শুঁড়ে তুলে আছড়ে ফেলছে। আর তাতেই হাতিদের খুনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্বের মূল কারন হল বনভূমির ক্রমহ্রাসমানতা ও বনভূমির মধ্যে হাতিদের পরিমিত খাদ্যের অভাব। এই দুই সাঁড়াশি আক্রমণে হাতিরা তাদের খাদ্য স্বভাবকে পরিবর্তন করে ফেলেছে শস্যক্ষেত্রে। এর ফলেই দ্বন্দ্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে ও লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।

ভারতের উপগ্রহ চিত্র (ISRO - Indian Space Research Organization) এবং সরকারি তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমাঞ্চলের জেলগুলিতে বনভূমির পরিমান ও ঘনত্ব এবং ভূগর্ভের জলস্তর নিম্নমুখী। তথ্য দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে - অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় ১৮৬২ সালে বনভূমির পরিমাণ ছিলো ৩১১০৪০ হেক্টর বা জেলার মোট ভূমির ২২.৮২ শতাংশ। প্রায় ১০০ বছর (১৯৬৪) পরে কমে দাঁড়ায় ১৩১৬৭৩ হেক্টর, যা জেলার মোট ৯.৬৬ শতাংশ। তারপরে নানা ধরনের সরকারি, আধাসরকারি এবং বেসরকারি বনসৃজন প্রকল্প ও উদ্যোগের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে এসে বনভূমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭০১৮৯ হেক্টর যা প্রায় ১২.০৪ শতাংশ। এখন বনভূমির পরিমাণ ১৭০৯০০ হেক্টর যা প্রায় ১২.১৪ শতাংশ (ঝাড়গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর মিলিয়ে)। ঠিক একই চিত্র বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলাতেও। বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ যথাক্রমে ১৪৬৩৫৬ হেক্টর (২১.২৭ শতাংশ) এবং ৯০৪০০ হেক্টর (১৪.৪৫ শতাংশ), যা মোট জেলার এক তৃতীয়াংশের যথেষ্ট কম।

সেই ১৮৯৮ সালে গড়ে উঠল খড়গপুর-ঝাড়গ্রাম রেলপথ। ১৯০৩ এ তৈরি হল মেদিনীপুর-শালবনি-গড়বেতা-বিষ্ণুপুর-বাঁকুড়া-আদ্রা রেলপথ। সৃষ্টি হল দ্রুতগামী শহরমুখী পরিবহন পথ। বাড়তে থাকল ছোট-বড় নগরায়ন। সব মিলিয়ে কাঠের চাহিদা বাড়তে থাকল। নতুন উদ্যমে শুরু হল গাছকাটা। পাশাপাশি স্থানীয় ভূস্বামীরা নানা ছল চাতুরির আশ্রয় নিয়ে এসব এলাকায় জঙ্গলগুলিকে নিজেদের মালিকানায় নিয়ে নিতেন। এরা যে সময় স্থানীয় ভাবে কাঠ পরিবহনের কাজে হাতির ব্যবহার করতেন ও হাতি পুষতেন। কিন্তু কাঠের ব্যাবসা লাভজনক হবার ফলে এসব এলাকার শাল, পিয়াল, বহেড়া ও কেঁদ গাছ কাটা পড়ে নির্বিচারে। ঐ সময় বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার সামন্ত পুঞ্জিরা পাঁচ বছরের জন্য নিলাম ডেকে ঠিকাদারদের কাছে শাল বন ইজারা তুলতো। এর ফলেই অপরিনত গাছে ছেদ ও বড় গাছের ঘনত্ব কমে গেল। আবার মাওবাদীদের কার্যকলাপের সুযোগে চোরাশিকারী ও ঠিকাদাররা বনভূমি লুট করে। ক্রমশ জঙ্গলগুলিতে বড় গাছের পরিবর্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাছ ও ছোট ছোট কাটছাঁট বনভূমি (Patches of Forest) পরিনত হয়। সেই কারণে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জেলায় বনভূমিগুলি যেন খাপছাড়া ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন, ঘনসন্নিবিষ্ট নয়। বহু জায়গায় আবার চারপাশে চাষের জমি ও বসতির মধ্যে দ্বীপের মতো অবস্থান করছে।  শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে অরণ্য ভূমির উচ্ছেদ ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক শালবনিতে ইস্পাত প্রকল্পের জন্য অরণ্যভূমির উচ্ছেদ ক্রমবর্ধমান। ঝাড়গ্রামেও রেললাইন সম্প্রসারণে ও প্রশাসনিক অফিস আদালত গড়ে তোলার জন্যও বহু পুরানো শালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। যা নিয়ে পরিবেশবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

হাতিদের পরিব্রাজনের কারন হিসাবে বৃহৎ বনভূমির পরিবর্তে ছোট ছোট অবনমন বনভূমির (Patches of Forest) সৃষ্টি ও বনভূমির মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের অভাব (Depletion of natural food habitat in the forest)। বর্তমানে জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক খাবার, বাসস্থান এবং জলভান্ডারে টান পড়েছে। তাই হাতিগুলি দিনে দুইবার - লাঞ্চ ও ডিনারের নামে আবাদি জমিতে ঢুকে পড়ছে। খুব ভোরে লাঞ্চ সেরে দিনের আলো বাড়ার আগে জঙ্গলে ঢুকে যায়। ডিনার খেতে নামে সন্ধে নামলে। সাধারণত সন্ধে থেকে ভোর রাত্রি পর্যন্ত চলে, মধ্যদিনে দলমার হাতিরা বিশেষ জমিতে নামে না। আদিবাসী সম্প্রদায়রা দারিদ্র্যের অভাব মোচনের জন্য হাঁড়িয়া ও মহুয়া খায়। যে মদ তারা নিজেরাই বানায়, হাতিরা হাঁড়িয়া ও মহুয়ার লোভে গ্রামে ঢোকে। প্রতিবছর দলমার হাতিরা ঘরবাড়ি ভেঙে মদ লুঠ ও চুরি করে। এতেই আর্থ সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে আরণ্যক আদিবাসী পরিবারে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর হিসাব অনুসারে - ভারতবর্ষের জঙ্গলগুলিতে মোট ১৭০০০-২২০০০ বন্যহাতি এখনো টিকে আছে। ১৯৭৫ এর আগে প্রতিবছর ১৫০-২০০ টি হাতি খুন হত চোরাশিকারীদের হাতে। কিন্তু এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে - ভারতবর্ষের বন্যপ্রাণী সংরক্ষন আইন (১৯৭২) এর সৌজন্যে। কিন্তু ১৯ শতকে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও বিহারের দুমকা জেলা ও ছোটনাগপুরের দলমার জঙ্গলে বাস করত কয়েক হাজার বুনো হাতি। ১৯৮২-৮৩ নাগাদ প্রায় ১০৭-১১০ টি হাতি পশ্চিমাঞ্চল - বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করে। এই সব অঞ্চলে প্রতি বছর বিভিন্ন কারনে ৬-৭ টি হাতির মৃত্যু ঘটে চলেছে। ২০১৯ সালে বিদ্যুতেপৃষ্ঠ হয়ে তিনটি দাঁতাল হাতির মৃত্যু হয় মালাবতীর জঙ্গলে। এইসব জঙ্গলে হাতি সংরক্ষণ ও বনভূমি করিডর গড়ে তুলতে হবে। ছোটনাগপুর মালভূমি সংলগ্ন ঘন জঙ্গলঘেরা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিচিত্র প্রাণীসম্পদ; সঙ্গে আদিবাসী নৃসমাজ ব্যবস্থা। জেলাগুলিতে এখন প্রতিনিয়ত জঙ্গল কাটা চলছে উন্নয়নের নামে। আর এই জঙ্গলের অভাবে গণ্ডার, বাঘের মতও দলমার হাতিগুলিও একদিন হারিয়ে যাবে। দলমার দামালের সংরক্ষণে  এলিফ্যান্ট করিডোর গড়ে তোলা হোক। তবেই রক্ষা পাবে দুইই নৃসমাজ ও বন্যপ্রাণী। 

ঝাড়গ্রামের, বেলপাহাড়ি-জামবনি-নয়াগ্রাম-মানিকপাড়া-লোধাশুলি; বাঁকুড়া জেলার ঝিলিমিলি, পুরুলিয়া জেলার কুইল্যাপাল এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ধেড়ুয়া-চাঁদড়া ও শালবনি-গোয়ালতোড় রেঞ্জের বিস্তীর্ণ বনভূমিতে এলিফ্যান্ট করিডোর (Elephant Corridor) গড়ে তোলা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষকে ট্যুরিজম গাইডের  প্রশিক্ষণ দিলে তারাই ট্যুরিস্টদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে হাতি দেখাতে পারবে। তার ফলেই হতে পারে গ্রামীন কর্মসংস্থান ও আর্থ সামাজিক উন্নয়ন। পাশাপাশি জঙ্গলে হাতিদের খাদ্যসামগ্রীর বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো দরকার।  বনের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যের ভান্ডার গড়ে তুললে কিছুটা এই সংঘাত কমানো সম্ভব হবে।

(শেষ)

লেখক- অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর।

 

Mailing List