ভারতে সবুজ বিপ্লবের জনক শ্রদ্ধেয় এম.এস.স্বামীনাথন স্যরকে যেভাবে পেয়েছি, স্মৃতিচারণ করলেন কৃষিবিজ্ঞানী কাঞ্চন কুমার ভৌমিক

ভারতে সবুজ বিপ্লবের জনক শ্রদ্ধেয় এম.এস.স্বামীনাথন স্যরকে যেভাবে পেয়েছি, স্মৃতিচারণ করলেন কৃষিবিজ্ঞানী কাঞ্চন কুমার ভৌমিক
কাঞ্চন কুমার ভৌমিক
সালটা ১৯৯৪ !
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে বসে আছি রেজাল্টের অপেক্ষায়। টিভিতে একদিন নিউজ (সাক্ষাৎকার) দেখলাম শ্রদ্ধেয় স্বামীনাথন স্যর এবং বিশ্বের সবুজ বিপ্লব তথা বিশ্বক্ষুধা নিবারনের জনক, নোবেল জয়ী নরম্যন বোরলোগ স্যরের।
আমার শৈশবমনে গভীরভাবে নাড়া দিল। আমি প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। পুকুর, জমি জায়গা অনেকটাই। কাকু, জেঠু সব্বাই চাষবাস নিয়েই থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমনো পর্যন্ত যা কিছুই পেয়ে থাকি সবইতো চাষবাসের উৎপাদিত ফসল থেকে। যে জামাটা পরি তা চাষের ফসল তুলো থেকে। যে খাবার গুলো খাই, যে বিছানায় ঘুমাই, যে প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে থাকি তা সবইতো চাষবাসের ফসল।
আমাদের মাটির বাড়ি। প্রত্যহ ভোরে গোবর-জলে নিকানো উঠোনের গোময় পরিবেশের আঘ্রাণ। বাড়ির পুকুরে নানান মাছ, গুগলী, ঝিনুক ইত্যাদি। দালানে সব্জি, বেগুন, লংকা, টমেটো, লাউ, কুমড়া, কুঁন্দরী, পটল ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়ির উঠানে চরে বেড়াচ্ছে মুরগি, হাঁস, ছাগল ইত্যাদি। গোয়ালের গরুর দুধ আর মাঠ ভর্তি ধান এইসব কাজকর্মের মধ্যেই আমাদের জীবন কাটত। সেইঅর্থে হাটেবাজারে যেতে হতনা, যাকিছু দরকার সবটাই বাড়ির ফসল ।
মনের মধ্যে এমনটা ক্রমে গেঁথে গেল, কাজেই চাষবাস নিয়ে আমাকে আরো গভীরভাবে জানতেই হবে। মাধ্যমিকে বোর্ডের পরীক্ষায় ৮৮ তম স্হান লাভের পাশাপাশি ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় বৃত্তি পেতে শুরু করলাম। মনে জেদ ক্রমে বেড়েই চলছে। উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর ভর্তি হলাম নদীয়ার বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের সময় উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ৮৫ শতাংশের বেশী মার্কস থাকলে সরাসরি ভর্তি হওয়া যেত।
কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে গ্র্যজুয়েশন ও মাষ্টার ডিগ্রী পাশ করলাম ৯০ শতাংশের কাছাকাছি নম্বর নিয়ে। পেলাম জাতীয় বৃত্তি সহ ইউ.জি ও পি.জি স্কলারশিপ। কাজেই উচ্চ শিক্ষার জন্য টাকার ঘাটতি গুলি একটু একটু মিটতে শুরু করল।
এরপর গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার জন্য আই.আই.টি খড়গপুর এবং ভারতের কৃষিবিজ্ঞানের সেরা প্রতিষ্ঠান আই.সি.এ.আর ; এন.আই.আর.ডি; ম্যনেজ ইত্যাদিতেও বিভিন্ন কোর্স করলাম।
রাজ্য সরকার ও ভারত সরকারের উচ্চপ্রদস্ত আধিকারিক পদে চাকরি করতে করতে সর্বদা সুযোগ খুঁজতাম ছোলবেলার স্বপ্নের স্যর, শ্রদ্ধেয় স্বামীনাথন স্যরের সান্নিধ্য পাওয়ার। ইতিমধ্যে ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় পুরষ্কার এবং আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও পেয়েছি।
স্বামীনাথনের সঙ্গে লেখক
অবশেষে ২০১৫ র ২৪ শে ডিসেম্বর। স্যরের চিঠি পেলাম চেন্নাই এ এম.এস.এস.এস.আরের “ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি”র আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা ঐ কনফারেন্সে আমন্ত্রিত। আমার আবিষ্কৃত "কাঞ্চনকনা ও জৈব ইউরিয়া"-র তত্ত্ব সব্বার নজর কাড়ল!
সব্বার মাঝে আমি এক অতি সাধারণ কৃষিবিজ্ঞানী কিন্তু সেইদিনের আলাপচারিতা এবং স্বামীনাথন স্যরের সান্নিধ্য, ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হল। তারপর বহু আন্তর্জাতিক সেমিনার। স্যরের চির সবুজ বিপ্লবের তত্ত্বকে পাথেয় করে এগিয়ে চলা।
ক্রমে ভারতের বেশিরভাগ রাজ্য ছাড়িয়ে ঘুরে বেড়ালাম নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, বার্মা, বাংলাদেশ, রাশিয়া, উজবেকিস্থান, খাজাকিস্তান, তুর্কিমেনিস্থান, আফগানিস্থান, কুয়েত, ইস্তানবুল, বুর্কিনা ফাসো, সাহারা, ইউথোপিয়া, রিপাবলিক অব্ গিণি সহ এশিয়া, ইউরোপ, ইউনাইটেড আরব ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশগুলিতে।
স্বপ্ন বিশ্ব ক্ষুধা নিবারনের পাশাপাশি সঠিক পুষ্টির লক্ষ্যে বিষমুক্ত খাদ্য। স্বামীনাথন স্যরের চির সবুজ বিপ্লবের ধ্বজা বহন করে চলছি প্রতিনিয়ত। উনার হাত ধরে সবুজ বিপ্লব এলেও পরবর্তী পর্যায়ে অত্যধিক রাসায়নিক ব্যবহারের কুফল উনাকে বিব্রত করত।
উনি ৮০ র দশক থেকে বলে চলছিলেন “প্লিজ স্টপ টু ইউজ কেমিক্যালস”। সারা বিশ্বজুড়ে ততদিনে কেমিক্যল লবি খুবই সোচ্চার হয়ে চলছে। আজ চির সবুজ বিপ্লবের সুসংহত কৃষি, পারমা কালচার, রৃষিকৃষি ইত্যাদি নিয়ে সারা বিশ্ব তোলপাড়, যাতে করে একটু বিষমুক্ত খাবার বা বিষমুক্ত পরিবেশ পেতে পারি!
বাংলার দুর্ভিক্ষ তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল 'সবুজ বিপ্লবের জনক’ স্বামীনাথন স্যরকে। তাঁর উচ্চশিক্ষা শুরু হয়, কেরলে, জুলজির হাত ধরে। পরবর্তীতে তিনি মাদ্রাজ, দিল্লি ও আরও পরে নেদারল্যান্ডস, ইউকে, আমেরিকা থেকে একের পর এক ডিগ্রি সঞ্চয় করেন ও উচ্চশিক্ষা এগিয়ে নিয়ে যান।
স্বাধীনতার পর একটা বড় সময়কালে ভারতের খাদ্য শস্যের সংকটের জেরে মানুষের মুখে ভাত তুলে দিতে দেশকে নির্ভর করতে হত বিদেশি রাষ্ট্রগুলির উপর। সেই নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন দেশের ‘সবুজ বিপ্লবের জনক’ এম এস স্বামীনাথন। ম্যাগসাইসাই সমেত একাধিক বড় পুরস্কারে ভূষিত এই কৃষিবিজ্ঞানী এদিন চেন্নাইতে ৯৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
তাঁর জীবনের কিছু অজানা দিক একনজরে দেখে নেওয়া যাক। ১৯২৫ সালের ৭ আগস্ট মাদ্রাজের কুম্ভকোনমে জন্ম স্বামীনাথনের। ১১ বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবাকে। জেনারেল সার্জেন এমকে সাম্বসিবনের ছেলে স্বামীনাথন ১৫ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তাঁর উচ্চশিক্ষা শুরু হয় জুলজির হাত ধরে কেরলে। পরবর্তীতে তিনি মাদ্রাজ, দিল্লি ও আরও পরে নেদারল্যান্ডস, ইউকে, আমেরিকা থেকে একের পর এক ডিগ্রি সঞ্চয় করেন ও উচ্চশিক্ষা এগিয়ে নিয়ে যান।
বিদেশে পড়াশোনায় একটা বড় সময় কাটালেও স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত স্বামীনাথনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ। দেশের মানুষের মুখে খাবার যোগাতে তিনি কৃষি গবেষণায় মন দেন। উন্নত বীজ, জলসেচের মাধ্যমে দেশের পশ্চিম অংশ, মূলত পাঞ্জাবে তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। তাঁর হাত ধরে দেশ এক নতুন সূর্যোদয় দেখে কৃষিক্ষেত্রে। তিনিই হয়ে ওঠেন দেশের সবুদ বিপ্লবের জনক। দেশকে কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ করায় কার্যত তিনি ব্রতী ছিলেন। সবচেয়ে বেশি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ফলনের বাসমতি চাল তাঁর হাত ধরেই আসে।
স্বামীনাথন স্যর প্রতিনিয়ত খবর নিতেন। স্যরের এই ৯৮ বছর বয়সেও। কি আশ্চর্য !
সমস্ত ই-মেলে উনি আমার পরিবার, ছেলেদের খোঁজ নিতেন। অবাক হই কোন উচ্চতায় উনার মানসিক বিকাশ। আপন করে নেওয়ার কৌশল। এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার। আজ কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা আমার সার্থক। এবছর ২৪শে ডিসেম্বর স্যরের বাড়িতে গিয়ে দেখা করার জন্য ডাক পেয়েছিলাম।
স্যরকে কথা দিয়েছিলাম আগামী ২৪ শে ডিসেম্বর শ্রীলংকা থেকে ফিরে স্যরের কাছে যাব। কিন্তু সব শেষ!!
চিরতরে বিদায় নিলেন। স্যরের বহু চিঠি ও শুভেচ্ছা পত্র আমার কাছে রয়েছে যেগুলো পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। স্যরের পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা।
“ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্মং জানতা বাপ্য জানতা।
মৃত্যুকাল বশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্
ধর্মাধর্ম সমাযুক্তং লোভ মোহ সমাবৃতম্
দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু”
ওঁম দিব্যান লোকান সঃ গচ্ছতি
ওঁম শান্তি


