বৈদিক যুগের পর স্মৃতির যুগে বিবাহটা নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে গেল প্রায়, নারী পাচার যুগে যুগে: পর্ব – ৮ লিখছেন সুখেন্দু হীরা

বৈদিক যুগের পর স্মৃতির যুগে বিবাহটা নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে গেল প্রায়, নারী পাচার যুগে যুগে: পর্ব – ৮ লিখছেন সুখেন্দু হীরা
সুখেন্দু হীরা
মানব সভ্যতার দুটি শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হল 'ধর্ম' ও 'বিবাহ'। যা ধারণ করে মানুষ, সেটাই তার ধর্ম। আর 'যা বহন করে' তা হল বিবাহ। বিশেষজ্ঞরা একমত মানব সভ্যতার শুরুতে 'বিবাহ' নামক কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না। আরও ভালো করে বললে বলাযায় 'পরিবার' বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক। পিতৃ পরিচয়ে দরকার হত না। শিশুরা তার মাকে চিনত। কৃষিকাজ আবিষ্কারের পর পরিবারের ধারণা এলো। ক্রমশ পরিবার হয়ে উঠল পিতৃকেন্দ্রিক।
বৈদিক যুগেই বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য-এর মতে, বিবাহের উদ্দেশ্য ত্রিবিধ -আনন্দ উপভোগ, পুত্র লাভ ও ধর্ম লাভ। বেদে চার আশ্রমের মাধ্যমে ধর্ম পালনের কথা বলা হয়েছে - ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। এই গার্হস্থ্য ধর্ম পালনের জন্য বিবাহ জরুরী। বৈদিক যুগে বিবাহ প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হলেও নারীদের যৌন স্বাধীনতা ছিল। চাইলে মেয়েরা বিবাহ না করেও থাকতে পারতেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন বিবাহ প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে নারীদের প্রথম স্বাধীনতা হরণ করা হল।
বৈদিক যুগের পর স্মৃতির যুগে বিবাহটা নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে গেল প্রায়। মনু বললেন 'বিবাহ সংস্কার পরিবারের মূল ভিত্তি'। হিন্দু ধর্মে ষোলটি সংস্কারের মধ্যে বিবাহ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। মেয়েদের অবিবাহিত থাকাটা যুগের পরিপন্থী হয়ে গেল বলে পিতার কাছে কন্যা 'দায়' হয়ে উঠল। যেন তেন প্রকারেন কন্যাকে পাত্রস্থ করতে হবে, তাতে কন্যার অভিমতের কোন মূল্য দেওয়া হল না। যত দিন গেল কন্যা সন্তান পরিবারের বোঝা স্বরূপ হয়ে উঠল। কেন এরকমটা হল তার সঠিক ইতিহাস নেই। তবে সমাজতত্ত্বে অনেক তত্ত্ব আছে।
আজও আমাদের ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় 'কন্যাদায়' বড় 'দায়'। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে খুব কম পরিবার আছে খুশি হন। কন্যা সন্তান জন্মানোর পরদিন থেকে কন্যার অভিভাবকরা হিসাব-নিকাশ শুরু করে দেন। সংসার বাজেটে কতটা কমতি করলে কন্যার বিবাহের জন্য সঞ্চয় বাড়তি হবে। 'বরপণ' খাতায়-কলমে যতই বেআইনি হোক না কেন, বিবাহে যৌতুকের আড়ালে সুন্দরভাবে থেকে গেছে। সব মিলিয়ে কন্যাসন্তান আজও সমাজে কাঙ্ক্ষিত নয় সাধারণভাবে।
এই কন্যাসন্তানের একটা গতি করার দুশ্চিন্তাকে নারী পাচারকরীরা মূলধন করে ফাঁপিয়ে তুলেছে নারী পাচারের ব্যবসা। হ্যাঁ নারীপাচার একটি লাভজনক ব্যবসা। এ বিষয়ে পরে আলোকপাত করা যেতে পারে। কন্যা অভিভাবক যদি দরিদ্র হন, তাহলে তো কথাই নেই। সেই কন্যাদায়গ্রস্ত গরীব পিতাকে সহজেই টোপ দেয় পাচারকারীরা। বিনাপণে বিবাহ হবে। শুধু তাই নয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিবাহে একটি পয়সা খরচ করতে হবে না। পাত্রপক্ষ সমস্ত খরচ দিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। এইসব টোপ সহজেই গিলে নেয় হতভাগ্য কন্যার পরিবার।
এই সব দরিদ্র পরিবারগুলির খোঁজ রাখে পাচারকারীরা। এজন্য গ্রামবাংলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য চর। পরিবারের নিকটাত্মীয়রাও এই কাজ করতে পিছপা হয় না। কারণ এতে দরিদ্র পরিবারটির যেমন উদ্ধার পেল তেমনই হাতে এল দালালি বাবদ কিছু নগদ। বিয়েতে কোন খরচ নেই এমন সু-পাত্র দেখে বাড়ির লোকেরাও পাত্রের বাড়ির বিশেষ খোঁজ খবর নেয় না বা খোঁজ খবর নেওয়ার মতো তাঁদের ক্ষমতা নেই। অচিরেই মেয়েটির ঠাঁই হয় কোনও যৌনপল্লীতে। ফলে নাবালিকার অভিভাবক এবং পুলিশ প্রশাসন খোঁজ পায় না সেই কন্যার। এভাবে যৌন শোষণের বলি হয়ে কালের অতলে হারিয়ে যায় তাঁরা।
কন্যাদায় থেকে উদ্ধারের জন্য নাবালিকা অবস্থায় অচেনা, আধচেনা, ভিনদেশী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে দ্বিধা করে না অভিভাবকরা। হরিয়ানা সহ তত্সংলগ্ন অঞ্চলে যেখানে ছেলেদের অনুপাতে মেয়েদের সংখ্যা কম, বা 'কনে পণ' এত বেশি; সেখানে বাংলা মুলুকের মেয়েদের চাহিদা থাকে। সেখান থেকে ছেলেরা এসে নিজেদের খরচায় বিয়ে করে নিয়ে যায়। মেয়ের বাড়িতে কিছু অর্থ সাহায্য করে যায়। তারপর সেই মেয়ের সেখানে অবস্থা হয় ক্রীতদাসীর মতো। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামীর সমস্ত ভাইদের যৌন চাহিদা মেটাতে হয়।
ভিনদেশে বিবাহিত যে মেয়েটির দালাল মারফৎ বিয়ে হয়েছিল সেও পরে দালালি বা ঘটকালি করে। অথবা আগে কোনও মেয়ের ভাগ্যবশত ঐ ভিনদেশে বিয়ে হয়েছিল সেও পরে গ্রামে বাপের বাড়িতে এসে অনেক মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে।
এক্ষেত্রে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় - আমাদের প্রাচীন আপ্তবাক্য 'অজ্ঞাত কুলশীলের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক কদাপি নয়'- এটা মনে রাখা।
তথ্য ঋণ:
১. মনুসংহিতা: সম্পাদনা ও ভাষান্তর চৈতালি দত্ত (নবপত্র প্রকাশন)
২. যাদের বিয়ে হবে: ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় (দে'জ পাবলিশিং)
৩. সুন্দরবন থেকে নারী পাচার: সুখেন্দু হীরা
[সুন্দরবন আবিষ্কার: সম্পাদনা - জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী (গাংচিল)]


