বেয়ারার কোট তাঁর কোট এক! নিজের জন্য তিন পয়সার কলা আনতে ছাত্রকে মেরেছিলেন! মানব দরদি বিজ্ঞান-সন্ন্যাসী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

বেয়ারার কোট তাঁর কোট এক! নিজের জন্য তিন পয়সার কলা আনতে ছাত্রকে মেরেছিলেন! মানব দরদি বিজ্ঞান-সন্ন্যাসী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
সত্যব্রত দোলই
পৃথিবীর সব দেশেই প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ জন্মায়, আর কালের স্রোতে ভেসে তারা অচিরে বুদবুদের মত বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। দেশ তাদের মনে রাখে না, চিরন্তন জনসমুদ্রে তারা হারিয়ে যায়। মানুষের সৌভাগ্য এই যে, মাঝে মাঝে এর দু' একটি ব্যতিক্রম ঘটে থাকে। কালের বেলাভূমিতে দু'একজন মহামানব জ্ঞানে ও কর্মে নিজের পদ চিহ্ন রেখে জাতির ইতিহাসে বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এরূপ জ্ঞানতপস্বী কর্মবীর মহামানবের আবির্ভাবে জাতির হৃত সম্বিৎ ফিরে আসে। জ্ঞানে, কর্মে, মনুষ্যত্বে ও দেশপ্রেমে জাতির প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। এরকম একজন মহামানব ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, শিক্ষাদর্শে ও কর্মানুপ্রেরণায় বাঙালি তার জাতীয় কল্যাণের পথ দেখতে পেয়েছিল এবং জ্ঞানে-কর্মে, জনহিতে ও স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দী বাংলার জাতীয় ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণযুগ। এই যুগে সমাজ, ধর্ম, জাতীয়তা, শিক্ষা, শিল্প-প্রচেষ্টা প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে এমন কয়েকজন মহামনীবীর আবির্ভাব ঘটেছিল যাদের জ্ঞান ও কর্মের সাধনায় দেশহিতের আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় বাঙালির জাতীয় অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত হয়েছিল এবং বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতি বরণীয় হয়ে উঠেছিল। এই ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকের শুরুতে ঋষিপ্রতিম মনীষী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বসূরীদের কালোপযোগী সুযোগ্য উত্তরসাধক হিসেবে জাতিকে তিনি জ্ঞানে ও কর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষাব্রতী, জনসেবক, শিল্প-সংগঠক, জাতির কল্যাণে আত্মনিবেদিত প্রাণ যুগ-ঋষি। দেশের ও দশের কল্যাণে তিনি দধিচীর মত আত্মদান করে গেছেন। জীবন সংগ্রামে পরাজিত মস্তিষ্ক সর্বস্ব বাঙালিকে তিনি স্বাস্থ্য ও চরিত্রে বলীয়ান, কর্মে উদ্বুদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। দেশে শিক্ষাবিস্তার, শিল্প-প্রতিষ্ঠা, সমাজ-সংগঠন, আর্ত ত্রাণ, জাতীয় মুক্তি প্রভৃতি যে সব কাজের জন্য তিনি দেশবাসীর অন্তরে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর হৃদয়ের একটি মাত্র প্রেরণার পরিচয়ই পাওয়া যায়, তা হলো- স্বদেশ ও স্বজাতির সামগ্রিক কল্যান সাধন। নিঃস্বার্থ মানব সেবাই ছিল তাঁর প্রকৃত ধর্ম-বিশ্বাস। মানুষের সেবাই ভগবানের সেবা, আর মানুষের কল্যাণকর কাজেই ভগবানের পূজা-এই সব্বাই প্রশ্নচন্দ্রের জীবনে পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
মানুষের কাজের মধ্যে দিয়েই ভিতরের মানুষটিকে চেনা যায় এবং অন্তরের প্রেরণা তার বাইরের জীবনযাত্রায় প্রকাশ পায়। প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন যেন ত্যাগ ও সারল্যের প্রতিমূর্তি। রুগ্ন ক্ষীণদেহ মানুষটি ধনে-মানে-পাণ্ডিত্যে গৌরবের সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন অথচ বাঙালির সাধারণ পোশাক ধুতি-চাদর ও একটি গলাবন্ধ কোট বা শার্টই ছিল তাঁর নিত্য পোশাক এবং তাও ছিল কম দামের। কোনও দিকে তাঁর পারিপাট্য ছিল না, মুখে দাঁড়ি-গোঁফ ভর্তি, চুলগুলি এলোমেলো। শেষ বয়সে পরতেন হাতে কাটা সুতার তৈরি খদ্দরের খাটো কাপড়। প্রথম জীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা কালেও ছিল তাঁর এইরকম সাদাসিধা পোশাক- দেশী সস্তা কাপড়ের সাধারণ কোট ও পাজামা, তাও হয়তো প্রায়ই থাকত অ্যাসিডে পোড়া ও দাগ ধরা। প্রফুল্লচন্দ্রের পোশাক-পরিচ্ছদে এই সরলতা ও অন্তরের মহানুভবতা সম্বন্ধে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। চারুবাবু প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন রসায়নের ক্লাসে প্রথিতযশা অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্রকে দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। একটি চৌখুপি ছিটের কাপড়ের গলাবন্ধ কোট পরে রেজিস্ট্রি খাতা হাতে বেয়ারা ক্লাসে ঢুকলো। একটু পরে অবিকল একই কোট পরে অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র ঢুকলেন। বিলাত-ফেরত বিখ্যাত অধ্যাপক ছোট-খাটো মানুষটির কোনও আভিজাত্য নেই, টাই নেই, হ্যাট নেই, বেয়ারার মত একই কোট পরা। অবাক কাণ্ড। পরে ডেমনস্ট্রেটর গুপীবাবুর কাছ থেকে চারুবাবু জানতে পারেন প্রফুল্লচন্দ্র এক থান কাপড় কিনে চারটি কোট তৈরি করান। দুটি নিজের জন্য রাখেন আর দুটি তার বেয়ারাকে পরতে দেন। ভাবতে অবাক লাগে, যৌবনেও প্রফুল্লচন্দ্রের মন কতটা উদার ও আভিজাত্য বর্জিত ছিল।
শুধু পোশাক-পরিচ্ছদেই নয়, জীবনের সবক্ষেত্রেই প্রফুল্লচন্দ্র অতি সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তার গার্হস্থ্য জীবন বলে কিছু ছিল না। তিনি ছিলেন চিরকুমার। ছাত্রদের নিয়েই ছিল তাঁর ঘরসংসার। ল্যাবরেটরিই ছিল তার নিজের বাড়ি। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনাকালে ১১, আপার সারকুলার রোডের ভাড়া বাড়ির দোতলার একটা ঘরে তিনি থাকতেন। একতলায় ছিল তার বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানা। একজন বেয়ারা তাঁর রান্নাবান্না ও দেখাশুনা করত। রান্নাবান্না সামান্যই। কাপড়-চোপড় ও বিছানাপত্রেরও বাহুলা ছিল না। ওতেন একখানা দড়ির খাটিয়ায়। ক্ষীণ স্বাস্থ্য আচার্যদের ছিলেন একান্ত স্বপ্নাহারী। খেতেন সাধারণ বাঙালি খাদ্য ভাত, ডাল ও একটু মাছ। শোনা যায়. একদিন তার আহারের কথা উঠতে এক ছাত্রকে বলেন, “আজ বেশ খেলাম রে-ভাত, মুসুরীর ডাল আর আলুসিদ্ধ খেয়ে দেখিস একেবারে অমৃত, আমি মাঝে মাঝে খাই।" আহার-বিহারে প্রফুল্লচন্দ্রের এই ত্যাগ ও সংযম সে যুগে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। মহামতি গোখেল তাকে 'কবি-রাসায়নিক' আখ্যা দিয়েছিলেন। গান্ধীজি লিখেছিলেন, “শুনে শ্বাসরোধ হয়ে আসে যে, আচার্য রায় তাঁর রাজোচিত বেতন থেকে নিজের জানো মাত্র কয়েকটি টাকা রাখেন, বাকী সব জনহিতে, বিশেষতঃ দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্যে ব্যয় করেন। "
প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রফুল্লচন্দ্রের বেতন ছিল মাসিক সাতশ টাকা। বিজ্ঞান কলেজে বেতন ছিল মাসিক হাজার টাকা। এছাড়া বেঙ্গল কেমিক্যালের ডিরেক্টর ও অংশীদার হিসেবে প্রচুর টাকা পেতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকের দক্ষিণা ও নানা স্থানে বক্তৃতার জন্যও পেতেন সম্মান-ভাতা। সরকারী পেনশনও পেতেন মাসিক ৪০০ টাকা। বেতন থেকেই তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছেন। এসব নানা দিক থেকে তাঁর রাজোচিত উপার্জন ছিল। কিন্তু তিনি নিজে সন্ন্যাসীর মত ত্যাগীর জীবনযাপন করতেন। আর তাঁর সমস্ত অর্থ জনহিতে ও দেশহিতে ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন কল্যাণকর্মে তাঁর দানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। আবার অনেক নান তিনি যথাসম্ভব গোপন করতেন। প্রতি মাসের প্রথম রবিবার বিজ্ঞান কলেজের বারান্দায় অসংখ্য দরিদ্র ও অনাথ ছাত্রদের সমাগম হত। এদের সবাইকে পড়াশুনার সাহায্যার্থে তাঁর মাসিক দানের বরাদ্দ থাকত। সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র বিধবাদেরও তিনি এরকম মাসিক সাহায্য করতেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল ও অন্যান্য শিল্পসংস্থার শেয়ারগুলির আয় বিভিন্ন বিধবাশ্রম, অনাথ আশ্রম, খদ্দর-প্রচারের ব্যবস্থা প্রভৃতির জন্য নির্দিষ্ট করে তিনি একটি ট্রাস্ট গঠন করে ট্রাস্টীদের হাতে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞান কলেজে শেষ ১৫ বছরকাল প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর অধ্যাপক পদের মাসিক বেতন না নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল ও অন্যান্য যে সব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের তিনি ডিরেক্টর ছিলেন, সেগুলি থেকে ডিরেক্টরের দক্ষিণা হিসেবে যা প্রাপ্য হতো, তা তিনি নিজে গ্রহণ করতেন না। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সুখ-সুবিধা ও আনন্দ বিধানের ব্যবস্থার জন্য সেই সব অর্থ দান করতেন। অথচ নিজের সুখ-সুবিধার দিকে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বিজ্ঞান কলেজে তাঁর ঘরে পাখা নেই দেখে একবার তাঁর এক ছাত্র একখানা পাখা লাগাতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালা দেখিয়ে ছাত্রটিকে জিজ্ঞাসা করেন- "এটা কোন দিক রে?” ছাত্রটি অতশত না বুছে 'দক্ষিণ দিক' বলতেই প্রফুল্লচন্দ্র বলেন, তবে? তবে আবার পাখা কেন? এমনিই কত হাওয়া"
সকলের মধ্যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র দেখতেন নিজেকে এবং নিজের মধ্যে দেখতেন সবাইকে। ভগবদ্ গীতার কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন যোগযুক্তাত্মা ও সমদর্শী। “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি / ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।” নিজের সুখ সুবিধার জন্য সামান্য মাত্র ব্যয়েও তাই কুণ্ঠিত হতেন বা কৃপণতার পরিচয় দিতেন। অথচ পরের সাহায্যে ছিলেন মুক্তহস্ত। নিজের জন্য অপরিহার্য ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় মাত্রকেই তিনি মনে করতেন দরিদ্রকে বঞ্চনা বা চুরির সামিল। ত্যাগেই ছিল তাঁর ভোগের আনন্দ; যাকে আমাদের শাস্ত্রে বলেছে— “তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জীথাঃ।” পরের জন্য অকাতর ত্যাগের উদাহরণ স্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। বিজ্ঞান কলেজে যে সব গরীব ছাত্র প্রফুল্লচন্দ্রের খরচেই পড়াশুনা করতেন এবং তাঁর সঙ্গে থাকতেন, তাদের মধ্যে নদীয়াবিহারী অধিকারী ছিলেন অন্যতম। নদীয়া বিহারীর উপর ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের গৃহস্থালী ও জমা-খরচের হিসাব রাখার দায়িত্ব। বাজার থেকে প্রতিদিন সে আচার্যদেবের জন্য এক পয়সায় দুটি ছোট চাঁপাকলা আনত। একদিন সখ করে নদীয়াবিহারী প্রফুল্লচন্দ্রের জন্য দুটি বেশ বড় ও ভাল চাঁপাকলা আনেন তিন পয়সা দিয়ে। আচার্যদেব কলা দুটি দেখে তো খুব খুশি। কিন্তু দাম তিন পয়সা শুনে রেগে একেবারে আগুন। "কি ? আমার জন্য এত খরচ, নবাবী করতে আরম্ভ করেছ ?" বলে নদীয়াবিহারীর চুলের মুঠি ধরে পিঠে দিলেন দু-ঘা। এই ঘটনার ঘন্টা দুই পরে প্রফুল্লচন্দ্র যখন ল্যাবরেটরিতে কাজে ব্যস্ত সেই সময় এলেন ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। ডাঃ ঘোষ তাঁদের অভয় আশ্রমের কাজে খদ্দর প্রচার ও অন্যান্য দেশহিতকর অনুষ্ঠানের জন্য সাহায্য ও পরামর্শের জন্য মাঝে মাঝেই প্রফুল্লচন্দ্রের শরণাপন্ন হতেন। ডাঃ ঘোষ জানালেন কিছু টাকার বিশেষ দরকার। প্রফুল্লচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন-কত? উত্তরে ডাঃ ঘোষ জানালেন- হাজার তিনেক। অমনি ডাক পড়ল হিসাবরক্ষক নদীয়াবিহারীর। ব্যাঙ্কের খাতায় কত টাকা জমা আছে দেখবার জন্য আদেশ হল। খাতা দেখে নদীয়াবিহারী জানালেন তিন হাজার পাঁচশ টাকা। আচার্যদেব বিনা বাক্য ব্যয়ে ও নির্দ্বিধায় তিন হাজার টাকার চেক কেটে দিলেন ডাঃ ঘোষকে। এমনই ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এই হল তাঁর রাজর্ষি মনের প্রকৃত পরিচয়।
বিজ্ঞানীরা সাধারণত সমাজবিমুখ। তাঁরা নিজ নিজ সাধনাতেই নিমগ্ন থাকেন বা বৃহত্তর আহ্বানে তারা সচরাচর সাড়া দেন না। কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন এর ব্যতিক্রম। দেশে বিবিধ রাসায়নিক উপকরণ উৎপাদন থেকে শুরু করে কৃষির উন্নতি, কলকারখানা ও শ্রমশিল্পের বিস্তৃতি সব ব্যাপারেই তাঁকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এই কর্মানুরাগ তাঁর নিছক আত্মপ্রকাশের প্রেরণা থেকে আসেনি, তার পেছনে ছিল সুগভীর দেশপ্রেম। এই নিরন্ন, হতভাগ্য, পরমুখাপেক্ষী দেশের বেদনা তাঁর বুকে বেজেছিল। তাই দেশকে বিদ্যা-বুদ্ধিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে-শিল্পে-সংস্কৃতিতে বড় করে তুলবার জন্য তিনি বিজ্ঞানের সুউচ্চ মিনার থেকে একেবারে পথের ধূলায় নেমে এসেছিলেন। এক হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যা বিতরণ করেছেন, আর অপর হাতে একের পর এক গড়েছেন শিল্প প্রতিষ্ঠান, রসায়নাগার, বিদ্যানিকেতন, জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান গৌরবের মতো কর্ম গৌরবকেও তিনি পরমার্থ মনে করেননি। যেখানে দুর্ভিক্ষ, যেখানে বন্যা, মহামারী, দুর্যোগ-দুর্বিপাক সেখানেই এই মহাপুরুষকে দেখা গেছে নামের জন্য নয়, বক্তৃতা দিয়ে আসর মাত করবার জন্য নয়, ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে দরজায় দরজায় ঘুরেছেন সেবার দ্বারা, আশ্বাসের দ্বারা বিপন্নকে বাঁচিয়ে ভুলবার জন্য। তাঁর সেই আত্মবিস্মৃত উদ্যম সমকালে অনেকেই চাক্ষুষ দেখেছেন।
সেকালের বরেণ্য ব্যক্তিমাত্রই তাঁর পরম সুহৃদ ও গুণগ্রাহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, কৃষ্ণকুমার মিত্র, ডাঃ নীলরতন সরকার, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রফুল্লচন্দ্রের চারিত্রিক মহত্ত্ব ও দেশ সেবার আদর্শে মুগ্ধ হয়ে তাকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৩২ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের ৭১ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির পক্ষ থেকে তাকে একটি জনসভায় সংবর্ধণা জানানো হয়। কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত এই সংবর্ধণা সভা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রফুল্লচন্দ্রের জীবন-সাধনার সঙ্গে এই অনুষ্ঠানটিকে বিশেষ সামঞ্জস্যপুর্ণ করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে কোনও সমারোহ বা জাঁকজমক ছিল না। চাঁদা আদায় হয়েছিল প্রায় সতেরো হাজার টাকা। কিন্তু খরচ হয়েছিল মাত্র ১৪৬ টাকা, টাউন হলের ভাড়া ও ডাকটিকিট বাবদ। অবশিষ্ট টাকায় ছাত্র-দরদী প্রফুল্লচন্দ্রের ইচ্ছানুসারে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যার্থে একটি ছাত্র-তহবিল খোলা হয়েছিল। সাধারণ জনগণের আন্তরিক অনুরাগ মিশ্রিত এরকম জাঁকজমকহীন আদর্শনিষ্ঠ জন্মজয়ন্তী উৎসব বিরল। এই জন্মজয়ন্তী উৎসবে সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি নিজের হাতে প্রফুল্লচন্দ্রের কপালে চন্দনের তিলক দেন এবং মাল্যদান করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণে বলেন, "আমরা দুজনে সহযাত্রী। কালের তরীতে আমরা প্রায় একঘাটে এসে পৌঁছেছি। কর্মের ব্রতেও বিধাতা আমাদের কিছু কিছু মিল ঘটিয়েছেন। আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে সেই আসনে অভিবাদন জানাই যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্রকে উদ্বোধিত করেছেন, কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি, নিজেকে দিয়েছেন, যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে। বস্তুজগতে প্রচ্ছন্ন শক্তিকে উদ্ঘাটিত করেন বৈজ্ঞানিক, আচার্য্য প্রফুল্ল তার চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন, কত যুবকের মনোলোকে ব্যক্ত করেছেন তার গুহাহিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি। সংসারে জ্ঞান-তপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে চরিত্রের ক্রিয়াপ্রভাবে তাকে ক্রিয়াবান করতে পারেন এমন মনীষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়। উপনিষদে কথিত আছে, যিনি এক তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের সৃষ্টিও সেই ইচ্ছার নিয়মে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েছেন। নিজের চিত্তকে সঞ্জীবিত করেছেন বহু চিত্তের মধ্যে। নিজেকে অকৃপণভাবে সম্পূর্ণভাবে দান না করলে এ কখনো সম্ভবপর হোত না। এই যে আত্মদানমূলক সৃষ্টিশক্তি এ দৈবশক্তি। আচার্য্যের এই শক্তির মহিমা জরাগ্রস্ত হবে না। তরুণের হৃদয়ে হৃদয়ে নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তা দূরকালে প্রসারিত হবে। দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে জয় করবে নব নব জ্ঞানের সম্পদ। আচার্য্য নিজের জয় কীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে- পাথর দিয়ে নয়, প্রেম নিয়ে। আমরাও তাঁর জয়ধ্বনি করি।”
তুমুল হাততালির মধ্যে প্রফুল্লচন্দ্র নিরাসক্ত মনে দেশবাসীর এই শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করেন এবং প্রত্যুত্তরে তাঁর চিরাভ্যস্ত ত্যাগপ্রোজ্জ্বল মনোভাবেরই পরিচয় দেন--- " যশের প্রত্যাশা না রাখিয়াই আমি নীরবে বিজ্ঞান-চর্চায় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি অতিবাহিত করিয়াছি, দেশমাতৃকার চরণে আমি যে সম্মান অর্ঘ্য দিতে পারিয়াছি, ইহাতে আমি কৃতার্থ বোধ করি, ইহার অধিক সম্মানলাভে আমার আকাঙ্ক্ষা কোনও দিনই হয় নাই।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের জীবন ও কর্মধারা বিশ্লেষণ করলে একটি কথাই মনে আসে যে, তিনি জ্ঞানে ও কর্মেই শুধু বড় ছিলেন না, তাঁর ভিতরের মানুষটিই ছিল উদার ও মহৎ। সেই মহত্ব বহুধা বিকশিত হয়েছিল তাঁর জনসেবা ও আত্মত্যাগে। নিজের খণ্ড স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্যকে সর্বসাধারণের অখণ্ড স্বার্থের মধ্যে বিলীন করে, 'ব্যক্তিগত আমি'কে 'সর্বগত আমি'র মধ্যে নিমজ্জিত করে তিনি পেয়েছিলেন পরমার্থের সন্ধান। তাতেই সমাজে বহুবিধ কল্যান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে তাঁর কর্মে এবং বাণীতে। এখানেই তার ব্যক্তিত্বের মহিমা। বাংলার যুব সম্প্রদায় যদি প্রফুল্লচন্দ্রের এই মহৎ আত্মত্যাগের অনুসরণ করে নিজেদের জীবন গঠনে প্রয়াসী হয়, তবেই বহু দুরূহ সমস্যার সমাধানে বাংলার ভবিষ্যৎ গৌরবোজ্জ্বল হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই।
লেখক: অধ্যক্ষ, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, মেদিনীপুর।


